[নটরডেম কলেজ নাট্যদলের বার্ষিক মুখপত্র ‘মঞ্চ’, চতুর্থ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৭ তে প্রকাশিত]
মানবজীবনটা বিচিত্র এক রঙ্গমঞ্চ। আমাদের আশেপাশে একটু ভালো করে তাকালেই খুঁজে পাওয়া যাবে অসংখ্য বিচিত্র স্বভাব ও কর্মের মানুষ, যারা এ রঙ্গমঞ্চে প্রত্যক্ষ অভিনেতার আসনে আসীন। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার মিশেলে অসাধারণ এক দৃশ্যকাব্য যেন এই জগত-সংসার। সকলেই নিজ নিজ চরিত্রে মৃত্যু বেদনালাভের আগ পর্যন্ত অভিনয় করে যায়। একেকটি চরিত্রে সকলের অভিনয়ের এই যে ব্যাপারটি বলা হয়, তা কিন্তু মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। বরং জীবনের সাথে নাট্যকলার এরূপ সরাসরি মেলবন্ধনই এই শিল্পকে করে তুলেছে আরো তাৎপর্যপূর্ণ। নাট্যকলা যেহেতু জীবনেরই প্রতিধ্বনি, সেহেতু এ শিল্পের সংস্পর্শে থাকা সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গ মাত্রই শৈল্পিক জীবনচর্চায় উৎসাহী ও অগ্রগণ্য হবেন- এটাই স্বাভাবিক।
সাহিত্যের একটি বিশেষ রূপশ্রেণী হলো নাটক; প্রাচ্যনাট্যশাস্ত্রে যাকে অভিহিত করা হয় দৃশ্যকাব্য বলে। গ্রিক ভাষা থেকে আগত ইংরেজি Drama শব্দটির কথাই বলি। এর মূল অর্থ দাঁড়ায় নড়া-চড়া করা, বা কিছু করে দেখানো। এইযে গতিশীলতা বা প্রবহমানতা, এটাই এই শিল্পের সাথে সবচেয়ে মানানসই ট্যাগ। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার সাথে একটু তুলনা করলেই পরিষ্কার হবে নাটকের গতিময়তা ও মানব জীবনের সাথে এর গভীর সামঞ্জস্য। মানব জীবন স্বচ্ছ নদের মত কিংবা উত্তাল সমুদ্রের মত গতিশীল- নাটকও তাই। তাই শিল্প সাহিত্যের সকল রূপবিভাগের মধ্যে নাটককেই জীবনের সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়। একটি শিল্পসম্মত সফল নাটক অবশ্যই জীবন-সংশ্লিষ্ট এবং তা সমাজ-গোষ্ঠী ও ব্যক্তিমানসের ওপর যতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে, ততটুকু আর কেউ পারে বলে মনে হয়না। দর্শকের ওপর নাট্যকলার প্রভাব নিয়ে শুরুতেই এগোবো না, সে আলোচনা শেষের শুরুর জন্য তুলে রাখলাম।
একজন অভিনেতাকে একটি নাটকে মূলত একটি চরিত্রকে বাস্তবায়ন করতে হয়। অর্থাৎ একটি চরিত্রকে সর্বাঙ্গে ফুটিয়ে তোলাই তার কাজ। কাজটি কিন্তু ততটা সহজ নয়, যতটা মনে হতে পারে। এক চরিত্র থেকে বেরিয়ে অন্য চরিত্রে প্রবেশ করাটা কিন্তু চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। সীমিত সময়ের জন্য হলেও অন্যের ভূমিকায় নিজেকে উপস্থাপন করার মধ্যে যে শিল্প লুকিয়ে আছে তার স্বরূপ উন্মোচন করা যাক। এইযে অন্য একটি চরিত্রকে নিজের করে নেয়া, এর মধ্য দিয়ে একজন অভিনেতার অভিনয় তথা অনুকরণ দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় বললে কম বলা হবে- অভিনেতার ব্যক্তিত্ব ও হৃদয়মানসের দৃঢ়তার পরিচয়ও মেলে। খুঁটিনাটি ঘেঁটে নিজেকে অন্য একটি চরিত্রের মত করে গড়ে তোলাটাই একজন অভিনেতার থেকে মুখ্য চাওয়া- তবেই তো শিক্ষা লাভ করা যাবে চরিত্রটি থেকে, কিছু শেখানো যাবে দর্শকদের। ক্ষেত্রবিশেষে একটি চরিত্রের জন্য অভিনেতাকে অনেক শ্রম ও ত্যাগ স্বীকারও করতে হয়। যার মধ্যে পড়ালেখা, জ্ঞানার্জন করা, নিজের মেধার সুচিন্তিত ও উপস্থিত প্রয়োগ- এবং সর্বোপরি সম্ভাব্য সকল দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা ও তুলনা করার ক্ষমতা অর্জন অন্তর্ভুক্ত। এভাবেই চরিত্রায়ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তির মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব যাচাইয়ের অলিখিত পরীক্ষা ও শৈল্পিক জীবনের দর্পণ।
নিয়মানুবর্তিতা জগতের অন্যতম পরম সত্য। জীবনে নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা পেতে শিল্প-সাহিত্য চর্চা অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আর শিল্প-সাহিত্যের প্রত্যক্ষতম ও সবচেয়ে জীবন-ঘনিষ্ঠ প্রশাখা হিসেবে নাট্যকলা এ গুণটির বিকাশেও রাখে সহায়ক অবদান। কাঠামোগত যেকোন দলীয় কাজ করতে গেলেই একজন বিদ্যার্থী যেসব নতুন অভিজ্ঞতা ও অনুপ্রেরণার সন্ধান পায়- ব্যক্তিত্ব বিকাশে তা অপরিহার্য। প্রতিদিন রিহার্সাল, কণ্ঠচর্চা, থিয়েটার গেমস প্রভৃতির মাধ্যমে যেমন নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা পাওয়া যায়, তেমনি নির্দেশক-পরিচালকদের বকুনি কিংবা ঝাড়ির মধ্যেও যেন খুঁজে পাওয়া যায় অমৃত জীবনবোধ। অনস্টেজ-অফস্টেজ সবরকম পার্ফরমেন্সই নিয়মের আওতাধীন, প্রাত্যহিক জীবনোন্নয়নে কোনোটির ভূমিকাই ফেলনা নয়। মূলত শিল্পিত জীবনচর্চার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই নিয়মানুবর্তিতা।
ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব প্রদর্শন ব্যতীত কোনো দলীয় পার্ফরমেন্সের সাফল্য আশা করা যায়না। সহকর্মীর জন্য সহমর্মী না হলে, ত্যাগস্বীকার, বিনয় প্রদর্শন ও সহযোগিতার মনোভাব বিকাশ করতে না পারলে শিল্পের ছোঁয়া পেয়েও আর পাওয়া হবে না। পাশাপাশি নেতৃত্বদানের গুণাবলি অর্জন, আনুগত্য শিক্ষা, সাহসিকতা ও চ্যালেঞ্জ নেওয়ার বাসনার গুরুত্ব আর না-ই বা উল্লেখ করলাম। নাট্যকর্মীর জীবনের বিকাশে নাট্যচর্চার ভূমিকা নিয়েতো অনেক আলাপ হলো, এবার যারা দর্শকসারিতে, তাদের ওপর এর প্রভাব কেমন তা দেখা যাক।
নাট্যকলার মাহাত্ম্য এখানেই যে, তা অন্য যেকোনো শিল্পমাধ্যমের চেয়ে দর্শকের ওপর গভীরভাবে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। একটা বই পড়ে, একটা গান শুনে, কবিতা আবৃত্তি কিংবা রচনা করে আমরা যতটুকু না শিখতে ও অপরকে শেখাতে পারি - আমার বিশ্বাস একটি সফল নাটক প্রদর্শন ও তা উপভোগ-বিশ্লেষণ করে আমরা তার বহুগুণে গ্রহণ করতে পারি- যেহেতু এতে ভিজুয়াল এলিমেন্ট জড়িত। নাটকে তো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকাহিনীরই অংশবিশেষ পাওয়া যায়। দর্শক এতে সরাসরি দেখে, খোঁজে নিজের জীবনের ছায়াপাত। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে, মনের অজান্তেই বলে ওঠে- আরে এতো আমার সমাজেরই কাহিনী, আমার নিজেরই বা পরিচিত মানুষের গল্প। এই জীবনঘনিষ্ঠতাই নাট্যকলাকে সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে দর্শককে উপযুক্ত আঘাত করার, মেসেজ দেয়ার। নাটকের ছড়িয়ে দেওয়া দর্শন ও বাণী দর্শককে ভাবায়, নতুন আঙ্গিকে চিন্তা করার খোরাক জোগায়, বাধ্য করে প্রয়োজনে আরো একবার বিবেকের দ্বারস্থ হতে। দর্শক একইসাথে শেখে শিল্পের মহিমা আর একে ফুটিয়ে তোলার এক ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। সমৃদ্ধ হয় দর্শক।
পরিশেষে বলা যায়, নাট্যচর্চার মধ্য দিয়ে নাট্যকর্মী, আর তা উপভোগ করার মধ্য দিয়ে দর্শক নিজের জীবনের সাথে তুলনায় মগ্ন হয়, ভুলত্রুটি খোঁজে। ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেন্স ফিল্ম ফেস্টিভালের একটা ওয়ার্কশপে একবার শ্রদ্ধেয় মুস্তাফা মনোয়ার স্যারের নেওয়া ‘নন্দনতত্ত্ব’ শিরোনামের একটা ক্লাস করার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে তিনি একটা খুব দামি কথা বলেছিলেন-
সব শিল্পকলাতেই সংযম-নির্ভর সৌন্দর্য আছে। সৌন্দর্যের অপর যেই শ্রেণিবিভাগ- ভোগনির্ভর, তা নেই। প্রাত্যহিক জীবনে সৌন্দর্যের দরকার পড়ে না, একে দরকারে এনে নিতে হয়। নান্দনিক বোধটুকু না থাকলে তাই শিল্পচর্চার অর্থ নেই।
বাস্তবিকও বটে। আর তাইতো দিনশেষে নাট্যকলা শুধুই একঝাঁক শিল্পীর পরিশ্রমের মিষ্টি ফসল কিংবা দর্শকের মননখোরাক ও নতুন চিন্তা উদ্রেককারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সবকিছুকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে দৈনন্দিন জীবনযাপনে শিল্পের ছোঁয়া লাগানোর অনবদ্য এক সম্মিলিত ও ব্যক্তিগত প্রয়াস। তাই নাট্যকলায় ও জীবনের মেলবন্ধনে সুন্দর শিল্পের জয়ই ঘোষিত হয় বারেবারে।