[নটরডেম কলেজের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ঢাক-ঢোল, এপ্রিল-জুন ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত]
‘কীভাবে শুরু করবো ঠিক বুঝতে পারছি না’- পাঠকের কাছে কথাটাকে তুচ্ছ মনে হলে হতেও পারে; কিন্তু লিখতে বসলে মনের মধ্যে আপনা আপনি এই অনুভূতিটা আপন অস্তিত্বকে সজোরে জানান দেয়। তার উপর লেখাটি যখন মূলত কলেজের নতুন পরিবেশে আগত নতুন অতিথিদের উদ্দেশ্যে রচিত হতে যাচ্ছে, তখন এই দোনমনাটা স্বাভাবিকই বটে।
নটরডেম কলেজ, মাতা মেরীর সুশীতল ছায়াতলে অবস্থিত বিদ্যাপীঠ, চোখ বন্ধ করেই যাকে দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়- সেই কলেজে ভর্তি হতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি, এবং আজীবন করে যাবো। যেহেতু কলেজের নবীন সদস্যরা এ সংখ্যাটাই প্রথম হাতে পেতে যাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যে দুচারটি কথা বলাকেই তাই যুক্তিযুক্ত মনে করছি।
কবি জীবনকে তুলনা করেছেন শৈবালের নীরের সাথে। বাস্তবিকই তাই। ১০ বছর স্কুলজীবনটা হয়তো সময়ের বিচারে বেশ বড়ই; আবার ছোটও! মনে হয়, এইতো কদিন আগেই স্কুলজীবন শুরু করলাম, আর মাত্রই না পেরিয়ে এলাম? আসলে মানবজীবনের কঠোর-মধুর সময় বাস্তবতা এটাই। সেই ১০ বছরের স্কুলজীবন শেষে জীবন নদীর বাঁক একটু অন্যদিকে মোড় নেয়। বড় দুর্গম এই পথ। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়- সময়ের ব্যাপ্তি মাত্র দেড় বছরের কাছাকাছি। অথচ মানবজীবনের নানা স্মৃতির চাদরে মোড়া এ অধ্যায়টিতেই জীবনের পরবর্তী গন্তব্য অনেকটাই নির্ধারিত হয়ে যায়। ছাত্রজীবনের শুরু থেকেই এসব শুনে বড় হওয়া সকল ছাত্রের কাছেই তাই কলেজলাইফ মোটামুটি ভয়ের আবার একইসাথে চরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে দাঁড়ায়।
আমি লেখাপড়া করেছি রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে। প্রাণপ্রিয় এই বিদ্যাপীঠ ছেড়ে যাবার প্রাক্কালে অজান্তেই যেমন পুরনো শেকড় বিচ্ছেদের বেদনা জেগে উঠেছিল মনে, তেমনি বহু আকাঙ্ক্ষিত কলেজ জীবনের সংস্পর্শ লাভের বাসনায় আনন্দে নেচে উঠেছিল মন। বলাই বাহুল্য, নটরডেমে ভর্তি হওয়াটাই ছিল সাময়িক একমাত্র লক্ষ্য। একরাশ রঙ্গিন স্বপ্ন বুকে বেঁধে এসএসসি-পরবর্তী দিনগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য হালকা প্রস্তুতি গ্রহণ পর্ব- অবশেষে এলো সেই দিন। ভর্তি পরীক্ষার ক্ষণ। পরীক্ষা ততটা আশানুরূপ হয়েছিল বলব না, তবে ক্যাম্পাস ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের অমায়িক আচরণ দেখে কোনো দুশ্চিন্তাই সেদিন মাথায় আসেনি। আনন্দের খবরটা যেদিন পেলাম, সেদিন থেকে আমিও নটরডেম পরিবারের একজন গর্বিত সদস্য হয়ে গিয়েছি। জ্ঞানাভিলাষীর কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানবহৃদয়ের একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ, স্বঘোষিত মহিমান্বিত স্থান। হয়তো এজন্যই জীবনের নতুন অধ্যায়ের শিরোনামটিকে আপন করে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করতে লাগলাম। এ অনুভূতি সত্যিই অবর্ণনীয়।
নবীনবরণের দিনটি ছিল সবচেয়ে আনন্দঘন। কলেজ প্রাঙ্গণে ততদিনে একেবারে নতুন ছিলাম না, শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রমের অজুহাতে কলেজের মাটিতে এর আগেও দুয়েকবার পা পড়েছিল। তবুও পরিবারের নবীন সদস্য হিসেবে কলেজ প্রাঙ্গণে প্রবেশের মাহাত্ম্যের সাথে কোনোকিছুরই তুলনা হয়না। বন্ধু-সহপাঠীদের সাথে উপভোগ করলাম নবীনবরণ অনুষ্ঠান ২০১৬। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা, অধ্যক্ষ এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের উপদেশমূলক বাণীগুলো আজও কানে বাজে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অংশটা তো ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখার জন্য উপযুক্ততম। একঘেয়েভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকলে বিরক্তির উদ্রেক ঘটা স্বাভাবিক, কিন্তু প্রাণবন্ত অনুষ্ঠানটি বিরক্তির লেশমাত্রকেও কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। এমন অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি নিয়েই শেষ হয় নবীনবরণ। বারবার মনে হচ্ছিল, লোকে যে প্রশংসা করে এ কলেজের, তা মিছেমিছি নয়। ধীরে ধীরে কলেজের ক্লাস শুরু হয়ে যায় আর সময়ের স্রোতের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনতরী বাইতে বাইতে কলেজের কঠোর নিয়ম-কানুন আর রীতিনীতিগুলোর সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চলতে থাকে। শিক্ষকদের বলা একটা কথায় খুব আকৃষ্ট হয়েছিলাম- ‘ল্যাব-কুইজ আর ক্লাব, এই তিন নিয়েই নটরডেম কলেজ’। যার প্রমাণ পেতে দেরি হলোনা, তোমাদেরও হবে না। এই কলেজে ভর্তি হতে পারাটা আসলেই অনেক ঈর্ষণীয় ও সম্মানের- এটা বুঝতেও সময় লাগবে না। কলেজের আদর্শ, পাঠপ্রদানের পদ্ধতি ও নিয়ম-আচার নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, তা হবে শুধুই রচনা বিস্তৃতকরণ। একজন নটরডেমিয়ান পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবেন আলোচ্য বিষয়গুলোর শ্রেষ্ঠত্ব ঠিক কোথায়! আর অনন্য রোল নম্বর সিস্টেমের কথাটা আর নাই-বা বলি।
তাৎপর্যপূর্ণ এ দুটি বছরে জীবনের রঙ্গমঞ্চে একজন নটরডেমিয়ান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য আমাকে সুযোগ করে দিয়েছেন- এজন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে অশেষ শুকরিয়া জানাই। তবে নতুন অধ্যায়ে বিচরণ করতে গেলে শুধু এর নতুনত্ব ও বৈচিত্র আস্বাদনের নিমিত্তে লেগে থাকলেই চলবে না, অধ্যায়ান্তে থাকে অনুশীলনীকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য তৈরি করাও সমান জরুরি। তা না করতে পারলে কিন্তু অধ্যায় আস্বাদনের সময়টুকু নিতান্তই মূল্যহীন হয়ে পড়বে। তেমনি জীবনে আদর্শ মানুষ হবার স্বপ্ন নিয়ে তোমরা যেই কলেজে ভর্তি হয়েছো- সেখানকার কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করলে জীবনে প্রকৃত মানুষ হওয়া কিংবা সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা থাকে শূণ্যের কোঠায়। যে নটরডেমকে নিয়ে আমাদের এত গর্ব তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ন রাখার গুরুদায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলের, নয়তো আমাদের নিজেদের এবং উত্তরসূরীদের কাছে আমরা দায়ী থাকবো। নতুন চলার পথকে মসৃণ করতে সময়ের সদ্ব্যব্যবহার, আদর্শ জীবনচরিত অনুসরণ, শিক্ষক-বড়ভাই-অভিভাবকদের প্রতি যথার্থ সম্মান ও কলেজের সর্বোপরি স্বার্থের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। তবেই যুগ-যুগ ধরে গর্ব করে যাওয়ার মত প্রেরণার গুপ্তধন পেয়ে যাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও। তবেই শিক্ষাজীবনের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদানের আনন্দ পাবে পূর্ণতা। তাই তোমাদের সুন্দর, শাশ্বত ও স্নিগ্ধ নবজীবনের প্রারম্ভে তোমাদেরই কণ্ঠে ধ্বনিত হোক -
আমরা রচি ভালোবাসার আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গপথের আভাস দেখায় আকাশ-ছায়াপথ,
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর স্বপ্ন দেখা হোক সফল-
আমরা ছাত্রদল!