এয়ারপোর্টে প্রথম রাত

রাত তখন প্রায় দুইটা বাজে। এয়ারপোর্টের ওভারপ্রাইসড কফি কিনে ওয়ান টাইম কাপে নিয়ে বসে আছি। আমার ঠিক বিপরীত চেয়ারে ফর্সা করে একটা ইস্ট এশিয়ান ছেলে, মাথা নিচু করে ল্যাপটপে মগ্ন। পাশে সুন্দর আকাশি-নীল ব্যাগ দেখে বুঝলাম কোডিং প্রবলেম নিয়ে ব্যস্ত। আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনাল ঢাকা এটেন্ড করা শেষে দেশে ফিরে যাচ্ছে, কোনো প্রবলেম হয়তো সময়ের মধ্যে মেলাতে পারেনি, তাই এখন বসে গুঁতিয়ে দেখছে একবার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম একই রকম আকাশি-নীল ব্যাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এদিক ওদিক। কেমন কেমন জানি লাগলো। সেই ফার্স্ট ইয়ারের পরে আর কোডফোর্সেসমুখো হয়ে ওঠা হয়নাই। আবার সাধারণত ঢাকায় এত বিদেশি স্টুডেন্ট-ফ্যাকাল্টি এভাবে একসাথে আসে না, আসলেও চোখে পড়ে না। এদিকে তাদের বাড়ি ফেরার সময় এতজনকে চোখে পড়লো আশেপাশে, যখন আমিই বাড়ি ছেড়ে জীবনে প্রথমবারের মত দেশের বাইরে পা রাখতে যাচ্ছি, তাও একা একা। সাতের থেকে পাঁচ ভাবতে ভাবতে কফিতে চুমুক দেই আর হাঁটা ধরি সিকিউরিটি চেকের দিকে। যতটা ভয় লাগবে ভেবেছিলাম অতটাও লাগছে না। এয়ারপোর্ট তো দেখি ভালোই ছিমছাম লাগে, ভেতরে হয়তো আরো অগোছালো আশা করছিলাম।

সিকিউরিটি চেক এক বিরাট হ্যাপা। এই জুতা খোলো, বেল্ট খোলো, এই ব্যাগ এখানে রাখো, ঐ ডিভাইস ঐখানে রাখো। তারপর আবার সেগুলা পরো, বা গুছায়ে জায়গামত নাও। প্রথমবারেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, আবার এক্সাইটমেন্টে সেটা চাপাও পরে গেল। ভিতরের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে এর ওর দিকে তাকাই, সময় কাটে না। অবশেষে সময় কাটাতে মানুষ যা করে ঐটাই করলাম। জুতা আর ঘড়ি যাতে ঠিকমত দেখা যায়, টিকেটের অর্ধেক যাতে বের হয়ে থাকে, এরকম স্টাইলে হাতে পাসপোর্টটা ধরে ছবি তোলা সারা। ব্যস, জাতে উঠে গেলাম হালকা করে। বাসায় ফোন দেই, কথা বলি। ডিসকর্ডে আলাপ চালিয়ে যাই জ্যাকব জুবাহ ডুকুলির সাথে।
জ্যাকবই হচ্ছে আমার প্রথম পরিচয় হওয়া কোনো আফ্রিকান স্টুডেন্ট। দেশের বাড়ি লাইবেরিয়ায়, কিন্তু লেখাপড়া করছে রুয়ান্ডায়। থার্ড ইয়ারে, আইটিতে পড়ে নেটওয়ার্কিং মেজরে। জ্যাকবের সাথে বেশ কিছু সিমিলারিটি খুঁজে পাই শুরু থেকেই, যার জন্য আলাপ জমে ভালোই। দুইজনেরই গায়ের রঙ কাছাকাছি, দেশের মুদ্রা টু ডলার রেশিও কাছাকাছি, আলমা ম্যাটারের র‍্যাংকিং কাছাকাছি, দেশের মার্কিন এম্বাসিতে কাছাকাছি যন্ত্রণার শিডিওলের দীর্ঘ লাইন, হায়ার স্টাডি নিয়ে বিপুল আগ্রহ, আগ্রহের চোটে বেশি বেশি প্রশ্ন করে আমাদের কো-অর্ডিনেটর ম্যাথুকে একই স্টাইলে জ্বালানো, শিক্ষক বা সিনিয়র গোত্রীয় সবাইকে প্রফেসর বা অমুক বলে সম্বোধন করার বদলে স্যার, ভাই বলে ডাকার মজ্জাগত অভ্যাস ইত্যাদি। লিস্ট বিশাল। যদিও পাশাপাশি দাঁড়ালে আমি মুশফিকুর রহিম আর সে ড্যারেন সামি (অতও না, বাট ওকে)। এরকম ছোটখাটো জিনিস বাদ দিলে বেশিরভাগই কমন। ভিসা প্রসেসিং থেকে শুরু করে টিকেট কাটা, ব্যাগ গোছানো, ডলার ভরা এসব হাবিজাবি নিয়ে প্রায় মাস দেড়েক ধরে আমাদের অনলাইনে আলাপ। ১৫ জন প্রোগ্রাম পার্টিসিপেন্টের মধ্যে দুজনের সাথে আমার কথা হয় যাওয়ার আগেই। দ্বিতীয়জন- ব্রিটিশ আন্ডারগ্র্যাড, কম্পিউটার আর্কিটেকচারে অলরেডি প্যাশন খুঁজে পাওয়া জোসেফ মুর। জোসেফই একমাত্র এটেন্ডি, যে শুধু শিখতেই আসে নাই নতুন জিনিস, ফাঁকে দিয়ে স্টুডেন্ট কম্পিটিশনেও তার একটা দলীয় সাবমিশন ছিল। জোসেফের সাথে আলাপের সূত্রপাত মজার, গ্রুপ চ্যাটে জিজ্ঞেস করছিলাম বাইরে কোন টাইপের কার্ড চলে বেশি, নন-নর্থ আমেরিকানরা কেম্নে কে কীভাবে প্ল্যান করতেসে এসব নিয়ে। এই ছেলে সুন্দর করে সব বুঝায়ে দিল ইনবক্সে। জোসেফের বাকি গল্প অন্য আরেকদিন।

তো এসব করতে করতেই ফ্লাইটের সময় হয়ে আসে। ঢাকা থেকেই যাত্রা, তাই প্লেনের মেজরিটি দেশি মানুষ। আমার পাশে এক তরুণ, বয়সে কয়েক বছরের বড় হবে হয়তো। ফান ফ্যাক্ট, তার সাথে আমার একটা কথাও হয়নাই, কেন জানিনা। সিটবেল্ট বাঁধতে কসরত করা লাগল, ভাই দেখি আবার কেমন একটা লুক দেয়। লেওভার স্টপেজ মাঝে একটাই, কাতার এয়ারলাইন্সের হোমগ্রাউন্ড- দোহার হামাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। মনে মনে চিন্তা করি- টাইমিংটা সেই! ফুটবল বিশ্বকাপ শুরু সপ্তাহ ঘুরতেই, অন্য যেকোনো সময়ের চেয়েই অনেক বেশি ফেস্টিভ থাকার কথা দোহার। আচ্ছা, ফেরার পথে কি প্লেনে উদ্বোধনী ম্যাচ দেখার সুযোগ হবে? ছোটবেলা থেকেই বাস ট্রেন যখন যেটায় ট্রাভেল করছি, জানালার পাশের সিটেই বসার অভ্যাস। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই রাতের ঢাকার এক অন্যরকম ছবি এক্সপেরিয়েন্স করলাম, এই ছবির জুড়ি তখন অবধি আমার মেমোরিতে দ্বিতীয়টা নাই। সেই নিকষ অন্ধকারের মাঝে মাঝে রানওয়ের হাল্কা লাইটের আলো দেখতে দেখতেই টেক অফ করলো প্লেন বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ। গন্তব্য? টেক্সাসের টেক-বিজনেস হাব ডালাস। উদ্দেশ্য? জীবনের প্রথম কোনো ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স এটেন্ড করা।

উচ্চতাভীতি আছে আমার। কত মানুষের কত শখ, ডানা থাকলে বোধহয় ভালোই হতো, উড়ে বেড়ানো যেতো আকাশে। পায়ের নিচে মাটি থাকবে না ভর দেওয়ার মত, এই ক্যাটাগরির শখের ধারে কাছে আমি নাই। কক্সবাজারে বন্ধুরা সবাই প্যারাসেইলিং এ জীবনের চরম আনন্দমুহূর্তের একটা এনজয় করে নিসে, আমি নিচে দাঁড়ায়ে হা করে তাকায়ে দেখসি এই নজিরও আছে। অতএব, প্লেন প্লেনের মত ওড়ে, আর আবারো একটা অদ্ভুত অনুভূতি। নিচে তাকালে পুরা ঢাকা শহরটার বুকে ছোট ছোট আলোর বিন্দু দেখা যায়, বিয়েবাড়ির সারা গায়ে সাজানো মরিচ তারাবাতির মত। আরো উপরে উঠলে- পিঁপড়ার মতো। মাটি থেকে আকাশে প্লেন তো কতই দেখলাম, এবার আকাশের প্লেন থেকে জমিন দেখাও হয়ে গেল- ভেবে তৃপ্তি বোধ করলাম।

তৃপ্তি বেশিক্ষণ টিকলো না, যখন বুঝলাম জানালার পাশে সিট নেওয়া ছিল একটা আবেগের বশবর্তী সিদ্ধান্ত। খাবার দিতে আসে এয়ার হোস্টেস, আমার গলা বাড়িয়ে কথা বলা লাগে। শুনলো না, আবার রিপিট। আমি শুনিনা, সে রিপিট। দুই সিটেই এই অবস্থা, ট্রানজিশনের পর তিন সিটের বেলায় কী হবে ভেবেই চিন্তিত। কাতারের খাবারের মেন্যু সব আগেই চেক করে দেখেছিলাম- ওভারল বেশ ভালই লাগে সব আইটেম (যদিও তুলনা করার মত এক্সপেরিয়েন্স এখন অবধি হয়নাই আর)। স্বাদও ভালই, ইন্ডিয়ান কুইজিনটা নতুন কাওকে টেস্ট করিয়ে দেখানোর জন্য মোটামুটি আদর্শ। টিপিকাল ভাত/পোলাও এর সাথে চিকেন/মাটন, ভেজ এসবই। কোক-জুস তো সবখানে একই, তবে ডেজার্ট আইটেম ছিল দুয়েকটা যেগুলো স্ট্যান্ডআউট করবে। খেতে খেতে সিটব্যাকের টিভি দেখব ভেবে রেখেছিলাম, চালু করতে গিয়ে দেখি কাজ করে না। এদিক ওদিক গুঁতাগুঁতি করি, কিন্তু মিডিয়া আর চালু হয়না, বড়জোর ম্যাপটাই দেখা যায়। এইটা কি শুধু এই রুটের প্লেনের সমস্যা? বিরক্ত হই, কিন্তু কিছু করার নাই। অগত্যা ঢাকা টু দোহা প্রায় ৬ ঘন্টাব্যাপী যাত্রার একমাত্র মনোরঞ্জন হয়ে দাঁড়ায় খাওয়াদাওয়া। আর এক পর্যায়ে কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুম। ঠিক ঘুম না, ঘুমের অভিনয়ে ঝিমানো। যাত্রাপথের প্রথম ধাক্কাটা খাওয়া তখনও যে বাকি!

রওনা দেওয়ার আগে কিছু সম্ভাব্য সমস্যার লিস্ট করে রেখেছিলাম। ঠান্ডা লাগবে অবশ্যই, শীত সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জেট ল্যাগ বলে যে কিছু একটা আছে, এইটা প্রথম আমি শুনি রওনা দেওয়ার দুয়েকদিন আগে। ওদিকে স্লিপ সাইকেল মোটামুটি ফাকড আপ, পড়ার খাতিরে রাত জাগা আর দিনে ঝিমানোই হয় বেশি। প্রোগ্রাম শিডিওল ওদিকে খুব টাইটলি প্যাকড, সকাল আটটার কমিটমেন্টও আছে। আমার মাঝে এরকম ভয়ও ঢুকে গেছিল যে আমার রাত বারোটার আগে ঘুম আসবে না, সকালের প্রোগ্রাম মিস করব ইত্যাদি। অতএব এই সমস্যার সমাধান, আগে আগে ঘুমাও। কিন্তু কেউ যেটার ব্যাপারে হেডস আপ দেয়নি, তা হলো প্লেন ল্যান্ডিং এর সময় দুর্দান্ত কানে ব্যথা হবে। সে এক ভয়ংকর এক্সপেরিয়েন্স। প্লেন যতই স্লোপ ডাউন করে, আমার কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। ইয়ারবাডগুলো দিয়েও দেখি কোনো সুবিধা হয়না। এভাবেই তীব্র কর্ণবেদনা নিয়ে একসময় প্রথম দেশের বাইরের কোনো মাটিতে পা রাখলাম। ব্যথা কমে গেলো ততক্ষণে, কিন্তু ভাই-ব্রাদার বন্ধুবান্ধব আচমকা কানে ধাম করে বাড়ি মারলে যেরকম লাগে, ওইরকম ব্ল্যাংক অবস্থা আমার তখন।

এয়ারপোর্টে নেমে ফোন চালাতে না পারার দুশ্চিন্তা অবশেষে দূর হলো। কানেক্টিভিটির একটাই উপায়, ফ্রি ওয়াইফাই আর হোয়াটসএ্যাপ। বেঁচে যে আছি সেই জানান দেওয়া হলো বিভিন্ন মহলে। খালাদের তরফ থেকে কর্ণবেদনার সমাধান আসলো- চুইংগাম বা সুগার প্যাকেট সাথে রাখা আর চাবানো। আরে! এই জিনিস মাথায় আসেনাই কীভাবে? ট্রানজিশন পিরিয়ড দুই ঘন্টারও কম, ফার্স্ট টাইমার হিসেবে ঝামেলায় পড়ার ভাল সম্ভাবনা আছে শুনেই এসেছিলাম। তবে দোহা এয়ারপোর্ট ছোটখাটো (শাহজালালের তুলনায় না অবশ্যই, দুবাইয়ের তুলনায়), আর চমৎকার রকমের গোছানো হওয়ার কারণে কোনো রকম বাধাবিঘ্ন ছাড়াই বাকিটা পথ পেরিয়ে গেলাম টার্মিনাল পয়েন্টার দেখে দেখে। এবার আর আশেপাশে পরিচিত কাটিং এর চেহারার দেখা নাই, হরেক রকমের বিদেশি। মাঝে একবার ওয়াশরুমের দিকে যাই, আর তখনই টের পাই নাহ আসলেই মিডল ইস্টে আছি। ক্লিনার, সুইপার, মেইনটেনেন্স সবার চেহারা দেখি সুপরিচিত কিসিমের- দেখেই বলে দেওয়া যায় নির্ঘাত ভারতীয় বা বাংলাদেশি।

এ মাথা থেকে ও মাথা প্রায় অর্ধেক রাস্তা চলে এলাম। এইরকম সময়ে চোখে পড়লো মাঝখানে বিরাট স্পেস নিয়ে বসিয়ে রাখা হামাদের ট্রেডমার্ক হলুদ বিশাল টেডি বিয়ার। সবাই ছবি নিচ্ছে, কেউবা তুলে দিচ্ছে অথবা জাস্ট সেলফি। সমাজের চাপে আবারও নতি স্বীকার করলাম, কিন্তু স্কিল ইস্যুর কারণে উৎপাদন হলো একটা আংকেলমার্কা পোজের সেলফি। ব্যথিত হৃদয়ে পা বাড়ালাম পরবর্তী ফ্লাইট ধরতে।

১০ নভেম্বর ২০২২