উড়ে যায়

বাইরে তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। বেগ আরেকটু কম হলে হয়তো ভালো হত, ছাদ পর্যন্ত যাওয়া যেত ভিজতে। সেটা এই মুহূর্তে সম্ভব না, তবে শখেরও কমতি নেই।

পিছন দিকের বারান্দাটায় আমার পছন্দের একটা বসার জায়গা আছে। পছন্দের বলার কারণ আসলে নরম চেয়ারটা না, চেয়ারে বসলে সামনে যে ভিউ পাওয়া যায়, সেটা। আশেপাশে বেশকিছু কদম গাছ, একেবারে গ্রিল ঘেঁষে, আকাশ মেঘলা আসার দিনগুলোয় বেশ একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এবং গাছ বাদে এদিকটায় উঁচু বিল্ডিং একেবারেই কম, ফলে খোলা আকাশটাও মন ভরে দেখে নেওয়া যায়।
হাতের কাজটা সেরে এককাপ গরম চা, আমার কবিতা লেখার ছোট ডায়রিটা, আর কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে চললাম পিছনের বারান্দার দিকে- এরকম সুযোগ হাতছাড়া করতেও ভয় লাগে। চেয়ারে গিয়ে বসে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে ভাবছি কি লেখা যায়।

আকাশ ভালোই অন্ধকার, বাতাসের ঝাপটা আছে এখনো ভালোই। লিখতে কি পারবো কিছু আদৌ, ভাবতে ভাবতে সামনের গাছটার দিকে তাকিয়েছি- আর এক পিলে চমকানো জিনিস চোখে পড়লো। কিছু একটা নড়ছে গাছের ডালটা ঘেঁষে, অর্ধেক গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। আলতো করে হাত দিয়ে সরিয়ে এনে ভেতরে গ্রিলের পাশে বসিয়ে দিলাম।

একটা ছোট পাখি। আবছা অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না কি পাখি হতে পারে। অদ্ভুতভাবে নড়াচড়ার কারণটা এবার বোঝা গেল- একটা ডানা কোনোভাবে ভেঙে গেছে বেচারার, কসরত করে যাচ্ছে এখনো। বাইরে বৃষ্টি কমার নাম নেই- কী করব বুঝে উঠতে না পেরে বসে রইলাম। কেমন অন্ধকার হয়ে আছে আকাশটা,থেকে থেকে বিদ্যুত চমকাচ্ছে- সাথে সেই চিরপরিচিত বৃষ্টির গন্ধটা! অল্প আলোতে একটু লেখার চেষ্টা করলাম কষ্ট করে, লিখলামও কয়েক লাইন। পাখিটাও চুপচাপ একদম- শব্দ নেই কোনো। পরের লাইনে কী লেখা যায়- কীভাবে শেষ করবো? আচ্ছা, এই গন্ধটা আসলে কিসের? বৃষ্টির? ভেজা মাটির? নাকি অন্যকিছুর? আচ্ছা, এই পাখি কি কথা বলতে পারে? অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, কিন্তু উত্তর মেলে না কিছুরই। প্রশ্নের দল বড় হতে থাকে, একটা ঘোরের মধ্যে বোধহয় চলে গেলাম-

— চাইলে সবই পারে!

আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো প্রাণীটা। নিজের কানকে বিশ্বাস করারও সময় নেই তখন। ঘোরের মধ্যেই বলে উঠলাম-

— মানে কী…

— না মানে, কথা বলতে পারি একটু-আধটু।

— আসলেই?!

— হুম। এইযে বলছি। তা কী লেখা হচ্ছে মনোযোগ দিয়ে?

আমাকে কিনা আবার জিজ্ঞেস করে কী লেখা হচ্ছে। ইন্টারেস্টিং!

— এই একটু কবিতা লেখার চেষ্টা করি আরকি-

— হুম্ম, কবিতা আমারো বেশ ভালো লাগে। তা বলি, লিখছো কী নিয়ে?

বিস্ময়ের আর অন্ত থাকলো না। একটু ইতস্তত করে বললাম-

— আছে, কত কিছু নিয়েই তো লেখার আছে… যখন যা মন চায় তা নিয়েই আরকি…

— এখন কী নিয়ে বসেছো?

এবার একটু বিরক্ত হলাম। কিছু একটা বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। আমাকে চুপ থাকতে দেখে কথা বলে উঠলো আবার,

— বুঝেছি। তা, মেয়েটা কে?

কণ্ঠে একইসাথে একটা চাপা দুষ্টোমি আর ব্যঙ্গ যেন বোঝা গেল।
বৃষ্টির ফোটা বেড়েই চলেছে। গায়ে এসে পড়ছে এবার জোরে জোরে। পাত্তা না দিয়ে নড়েচড়ে বসলাম,

— তা দিয়ে তোর কী…

— না, এমনি জানতে চাইলাম আরকি। আমার অভিজ্ঞতা বলছে- গবেষণাও বলতে পারো- এরকম সময়ে এরকম ওয়েদারে এরকম সেটিং এ বসে সামনে কোনো লেখাটেখা থাকলে সেটা এই রিলেটেড হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা…

পাখিটা কিছু একটা সংখ্যা বলে বসলো বিজ্ঞের মতো, ঠিক শুনে উঠতে পারলাম না, ইতোমধ্যেই একইসাথে যথেষ্ট বিরক্ত আর আশ্চর্য বনে গেছি।

— …তো আমার আসলে আমার জানার খুব ইচ্ছা, এমনটা কেন হয়। মনুষ্যপ্রজাতি বড়ই বিচিত্র। তোমার কী অভিমত-
কি বলব ভেবে পাচ্ছিনা। তবে মনে হচ্ছে এর সাথে কথা বার্তা চালানো যায়। কিছুটা বুদ্ধিশুদ্ধি রাখে। একটু সাবধান হয়ে বলা শুরু করলাম,

— ব্যাপারটা অত আহামরি কিছু না। মানুষের মনে ভালোমন্দ যা থাকে, একটু চেষ্টা করলে বের করে আনা যায়। বৃষ্টি, জোছনা, সমুদ্র, পাহাড়, যার যেরম পরিবেশে মনে হয়, মনের জানালা খুলে দিতেই পারে।

— বলতে চাইছো, এটা বৃষ্টি বা ঐসবের ক্রেডিট?

— হুম, তা বলা যায়।

— অদ্ভুত!

— যেমন ধরো, আমার কাউকে পছন্দ। তাকে নিয়ে আমার দু-চার লাইন লিখতে ইচ্ছা হতে পারে, বলতে পারো এই সময় এখানে বৃষ্টি একটা প্রভাবকের মত। প্রভাবক বোঝো তো? সোজা বাংলায় উসকানিদাতা!

— তা না হয় বুঝলাম! আচ্ছা, পছন্দ যখন, ওকে বলোনি?
দ্বিতীয়বারের মতো অপ্রস্তুত আর একটু বিরক্ত হলাম।

— অনেক কারণ থাকতেই পারে না বলার। পারে না?

— হয়তো পারে…

চিন্তিত শোনালো কথাটা, মনে হয় ভাবনায় পড়ে গেলো একটু-

— এই তোমাদের মনুষ্যজাতি বড়ই অদ্ভুত, আর কিছু না হোক, এটা এতদিনে বুঝেছি। কিন্তু…

— আবার কিন্তু কী-

— একটা জিনিস জানতে ইচ্ছা করছে।

— বলে ফেলো-

— বলোনি যখন মেয়েটাকে, তাহলে খারাপ লাগার কথা না? সেখানে দিব্যি আরামে আছো মনে হচ্ছে-

— এতক্ষণে একটা ভালো কথা বলেছো। এটা আমারো প্রশ্ন, যে ঘাপলাটা আসলে কোথায়-

— তুমি জানো না, শিওর?

শব্দ করে বিদ্যুত চমকালো, বেশ খানিকটা আলো আকাশ চিরে যেন বারান্দায় এসে পড়লো- পাখিটার অবয়ব এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টি কি আজকে আর থামবে না?

— জানলে তো বলতামই!

ডানাভাঙা আশ্চর্য পাখি মনে হলো আরো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি, অনেকটা পরিষ্কার দেখাচ্ছে এখন কেন যেন, মেঘেদের অবয়ব দেখা যায় সুন্দর- তিন চারটা ধূসর বিশাল টুকরার মতো। কাছাকাছি চলে আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে। ছায়াঘেরা কোনো এক কল্পনার রাজ্যকে যেন আড়াল করতে চাইছে বারবার, মেঘ কেটে গিয়ে দেখাবো দেখাবো করেও দেখাচ্ছে না। লুকোনো সেই রাজ্য থেকে যেন ঝরে পড়ছে কারও কান্নার মত জলধারা, কখনো জোরে তো কখনো বা আস্তে। বাতাসের ঝাপটা যেন আরো বেড়ে গেলো, গায়ে এসে লাগছে পানির ফোঁটাগুলো, চশমার গ্লাস তো কবেই ভিজে সারা। পাখিটা কি কিছু বলছে নাকি?

— আচ্ছা, বৃষ্টি ফুরোলেও কি তোমার মনে থাকে মেয়েটার কথা? একইরকম?

সামনের কদম গাছগুলো জোরে জোরে মাথা দোলাচ্ছে, একবার এদিক, একবার ওদিক। থেকে থেকে ভেসে আসছে সেই মিষ্টি, সুগন্ধ ঘ্রাণ। বিদ্যুত চমকালো বোধহয় দুবার, আলোর ঝলকানিতে মেঘগুলো দেখা গেলো আবার- কি অদ্ভুত সুন্দর ধূসর কালো। আস্তে আস্তে ছায়া কেটে যাচ্ছে, মেঘের ওপারে একটা সুন্দর সোনালি আলোর হাতছানি যেন ঠিকই অনুভব করা যায়। নাহ, সোনালি না, আচ্ছা এই কালারের নাম কী? দেখলে কত ভালো লাগে, অথচ নামটা মাথায় আসেও না। আশ্চর্য, কত রঙের নাম জানিনা ভাই!

উড়ে যাও না কেনো, এই ভাবে ডানা ভেঙে
বসে থাকা কেন্নো!

জন কবিরের আর্তচিতকারে আমার সম্বিত ফিরে এলো। আকাশে জাদুময় মেঘের আলোকচ্ছটা, মোহনীয় একটা সুরের তালে বৃষ্টি পড়ে চলেছে, গলির নিচে বোধহয় পানিও জমতে শুরু করে দিলো এতক্ষণে। চশমার গ্লাসটা মোছার চেষ্টা করলাম, লাভ হলো না, সবই ভিজে একাকার। কানে হাত দিয়ে দেখলাম, ইয়ারফোনটাও জবজবে ভেজা। বারান্দায় কোনো পাখি নেই।

পাশে কাপে হাত পড়লো, সাধের চা টা আমার বরফ পানি হয়ে পড়ে আছে।