আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম!

আমার স্মৃতি সময়ে সময়ে বেশ নাজুক, মনে রাখার মতো জিনিসগুলো মনে থাকে না সবসময়। এই যেমন কলেজের প্রথম দিনের কথা- নবীনবরণ দিনটার কথা এ টু জেড মনে আছে, এমনকি 'স্মরণকালের অন্যতম দ্রুত' ঘুম থেকে উঠে গোড়ান বাজার রোডে গিয়ে সমকাল-ফেরিওয়ালা খুঁজে বের করার সকালটারও ডিটেইলস মনে আছে- অথচ আজকে সকাল থেকে ভেবে ভেবে কলেজের প্রথম ক্লাসের মেমোরি খুঁজে বের করতে পারলাম না- খালি মনে পড়ে চারপাশে অনেক কিসিমের পোলাপান- ভিতরে না না জানি কে কিরকম, বাইরে একটা ক্রিম-কালো-ট্রান্সপারেন্টের প্যাকেটে মোড়া- ভার্সেটাইলিটি কাহারে বলে- জীবনে প্রথম চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা পাইলাম। সাথে রুদ্র স্যারের কথা শুনে বিনোদন পাইছিলাম, আর কোনো কারণে বন্ধু প্রেনন রে দেখে খুব ডিপ্রেসড হয়ে গেছিলাম ;-;

প্রথম দিনের কথা বেশি খেয়াল না থাকলেও এরপরের ১.৫ বছরের মহাকাব্যের টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলো এখনো আবছাভাবে চোখের সামনে ভাসে, মাঝে মাঝে মনে হয়- আবার যদি ফিরে যাওয়া যেত! খুব শখ ছিল পিংক স্লিপ নিয়ে ধরা খাওয়ার- আফসোস, পূরণ হয়নাই। মাঝে লুকায় লুকায় একদিন দারোয়ান মামাদের চোখে ধুলা দিয়ে কলেজে ঢুকলেও- ক্লাসে অতিরিক্ত বিতলামি করতে থাকায় নাকি কে জানে- জাবেদ স্যারের কাছে বড় চুলের কারণে কট খেয়ে আইডি কার্ড ফাদারের রুমে অবশ্য গেছিল। কিন্তু তাতে আশ মেটেনাই, আইডি যখন ফেরত নিতে যাব- ফাদারের সাথে প্রতীক্ষিত এনকাউন্টারের বদলে আইডি নেওয়া লাগছে মার্টিন হলের এক দাদার থেকে- কিছু হইলো এটা?

ফাদারদের সাথে এনকাউন্টার পরে অবশ্য কয়েকবার হইছে- কত সুন্দর সুন্দর স্মৃতি একেকটা ভাই! চেস ক্লাবের এক কনটেস্টের পর দাবা খেলার এডভান্টেজ নিয়ে বিস্তর আলোচনা, স্পোর্টস ডের মজার মজার স্মৃতি, ক্লাবের পিকনিকের স্মৃতি…কত কী! নবীনবরণের নাটকগুলো শেষ মুহূর্তে একবার ফাদারকে দেখিয়ে নিতে হতো- তখনকার কমপ্লিমেন্টগুলা একজন নর্মাল স্টুডেন্ট হিসেবে, অত বড় দলের একজন নগণ্যমাত্র সদস্য হিসেবেও খুব দামি ছিল আমার কাছে। শংকর স্যারের সাথে এনকাউন্টার বোধহয় একবারই- অনারেবল মেনশনের ফাইনাল রাউন্ডের ভাইভা হচ্ছে- কথা প্রসংগে জিজ্ঞেস করলেন- নাটক, সিনেমা তো দেখো- বাংলাদেশের বিখ্যাত দুয়েকজন ভিলেনের নাম বলো দেখিঃ চূড়ান্ত নার্ভাস আমি সেসময়, মাথায় মিশা সওদাগর ছাড়া আর কারো নাম আসে না- মুখ ফুটে বলার পর ভদ্রলোকের হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ- এটিএম শামসুজ্জামান, হুমায়ুন ফরীদির নাম কে বলবে? এত লজ্জা সেদিন পাইছি, জীবনে বোধহয় আর পাইনাই আগে পরে।

জীবনে খাওন-দাওনের হাল-হকিকত এখন অনেক ভালো আল্লাহর রহমতে, তারপরও সেই সকালের ‘লস প্রজেক্ট’ পিজা আর দুপুরের ‘লস প্রজেক্ট’ খিচুড়ি-মাংসের স্বাদ তো আর চাইলেই পাইনা। পাঁচ-দশজন একসাথে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রাইস-চিকেন গিলতে গিলতে নির্লজ্জের মতো কোন লজিকে এই বালের জিনিসের দাম ৭০ টাকা হয়- তা নিয়ে আলোচনা করা খুব মিস করি ভাই! বেল পড়ার সাথে সাথে গুলির বেগে আর শখানেকের সাথে সিংগারা যুদ্ধে পাড়া-গুতা খাওয়া তো ক্লাসিক অভিজ্ঞতা- কালকে একবার সুযোগ দিলে ঐ গুতা-পাড়া খাইতে আমি এক পায়ে খাড়া। আইডিয়াল পার্টির কাছে পর্যন্ত লোভনীয় ভেলপুরির কথা না বললে তো মহাপাপ, বার্গার কিং তো শালা আসলেও কিং। মান্নানের তেলাপোকা-সমৃদ্ধ ছোট্ট ঘরে বসে পেটভরে ডাইল-ভাত খায়ে যে শান্তি পাইছি- সেটা নিজের বাসা ছাড়া আর কোথাও পাইনাই। আর আপ্যায়ন/ঘরোয়ায় দলবেঁধে সময়ে অসময়ে গ্রিল-নান এটাক তো ইহজগতীয় ভোগ-আনন্দের ঊর্ধের জিনিস ছিল- এখন মনে করলে খালি কষ্ট-আক্ষেপ ছাড়া আর কিছু জোটে না।

সবথেকে আনন্দের ছিল ক্লাস আর বিকালের ল্যাবের ফাঁকের অলস দুপুরগুলা। একসাথে ঠান্ডাই টানা (ম্যান আই মিস পাড়াগলির ক্রিকেটার ব্রাভো ভাই), সবুজ ঘাসে ফুটবল লাত্থানো, কিংবা জাস্ট ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকায় থাকা, রিহার্সেলের ফাঁকে অডির মেঝেতে উলটা হয়ে শুয়ে থাকা, নামাজের রুমটায় হুদাই পড়ে থাকা, লাইব্রেরিতে গল্পের বই /পেপার পড়া অথবা একা একাই হেডফোনটা কানে লাগায়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় থাকা- খালি মনে হইতো সারাজীবনই এমনে চললে কি খুব মন্দ কিছু হইতো?

মাঝে মাঝে স্যার-ম্যাডামদের হাসি-খুশি মুখগুলা খুব মনে পড়ে- কত ভালোমন্দ স্মৃতি ক্লাসে-কোচিং এ, ভেতরে বাইরে! এক্কা স্যার-জহির স্যার-তাপস স্যাররে সর্বোচ্চ জ্বালাতন করে কিছুক্ষণ পরই সেন্টি খাওয়ার যে ব্যাপারটা, রেজা স্যারের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে জীবনে ভালোমন্দ পড়াইতে না পারি- এই লোকটার মতো ছাত্রদের সাথে যেন কথা বলতে পারি এই প্রতিজ্ঞা করাটা, সুজিত স্যারের কথা শুনে এক ক্লাসে কড়া মোটিভেটেড হয়ে পরের ক্লাসেই ঘুমায় যাওয়ার ব্যাপারটা, ক্লাসের আগে পড়ে গরমে ঘেমে ভূত হয়ে বিপ্লব স্যার-সুশান্ত স্যার-ফরহাদ স্যার-নয়ন স্যারদের কাছ থেকে এক কানে পড়া আরেক কানে খাঁটি ভালোবাসা ঢোকানোর যে দিনগুলা- সত্যিই খুব মিস করি। দুই নাম্বার যে জিনিসটা খুব কাঁদায়- হ্যারিংটনের তিনতলার বারান্দা। মাঝের ৫ মিনিটের গ্যাপগুলা যেন খালি আমি বাইরে বাইর হয়ে মানুষের চেহারা দেখতে পারি এই জন্যই কোনো কালে কেউ প্রবর্তন করে গেছিল- বারবার এমনটাই মনে হইতো। লাইফ সেভিওর জিনিস ছিল এই করিডোর। কুইজে বাঁশ-টাশ খেয়ে চূড়ান্ত ডিপ্রেসড হয়ে এই করিডোরটায় ফাঁকে ফাঁকে সময় কাটাইলে মনটাই ভালো হয়ে যাইত পুরা।

দিন যাইত, দিন আসতো- ক্লাস/ল্যাব/কুইজের প্রেসার চলতেইছে, ফেস্ট থাকে প্রায় সব উইকেন্ডেই, সত্যি বলতে কেনো জানি জীবনে কোনো আক্ষেপ ছিল না এই সময়টায়, না কোনো তাড়াহুরা। সবই সুন্দর, সাজানো গোছানো একটা গল্পের মতো। দেখে গেছি, করে গেছি সময়-সুযোগমতো সব। প্রচুর মানুষের সাথে মিশছি- ভালো খারাপ সব ধরনের। বয়সের কথা বলি, ঘটনার গুরুত্ব আর গভীরতার কথা বলি- সব মিলিয়েই এই সময়টা সবার জীবনেই ভালো রকমের প্রভাব ফেলে- নটর ডেম সেটাকে খুব যত্নে রাঙ্গায় তুলছিল- অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো বটেই। তখনই ভেবে রাখছিলাম, এটাই বোধহয় সেরা আলমা-ম্যাটার জীবনের। বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো বুয়েটের, সিদ্ধান্ত বদলায়নাই- বদলাবে বলেও মনে হয়না।

লাস্ট দিনের হাবীব স্যারের লাস্ট ক্লাসটার কথা খুব ভালোভাবে মনে আছে- নটরডেমের কুকীর্তির কথা শুনছিলাম আগেই, জানলা দিয়ে বাইরে সন্ধ্যার আকাশের দিকে তাকায়ে খালি মনে হচ্ছিল, আজকেই বোধহয় সেই দিন। ঘন্টা খানেক পর ফোনে মেসেজ পায়ে তাই খুব একটা অবাক লাগেনাই। সেদিন কি কারণে একটা কথা মনে হচ্ছিল আর হাসি পাচ্ছিল- দেখতে দেখতে দিন চলে যাবে কেমনে- এইচএসসি দিব, এডমিশন দিব, কই না কই ভর্তি হব, ক্লাস করব, বুড়া হয়ে যাবো আস্তে আস্তে, দিন-মাস-বছর পার হয়ে যাবে- মাঝে মাঝে এইসব উপলক্ষে কি মনে করে এই দিনগুলোর কথা লিখতে বসবো। হাসি এখনো আসতেছে- বলদের মতো এতগুলা কথা লিখতেসি বসে বসে, কতজনই পুরাটা পড়বে, পড়ে লাভই বা কী হবে তাই ভেবে।

দিন যাবে, সামনে এরকম লেখার উপলক্ষ আরো আসবে, ৭০ বছর পূর্তিতে ঐরকম এলামনাই এলামনাই অনুভূতিটা খুব মিস করছি- বেঁচে থাকলে সেইটাও হয়তো পাওয়া হবে- ১০০তে, হয়তো? কিন্তু আগের মতো মামাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে হেরিংটনের ছাদে উঠে খোলা বাতাস খাওয়া হয়তো আর হবে না, জীবন এমনই। সামনে আগায় যাবে- তালে তালে আমরাও আগাব, মাঝে দুই দণ্ড সময় বের করে হা হুতাশ করব- আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!